বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও সম্মানজনক পুরস্কার গুলির মধ্যে একটি হলো নোবেল পুরষ্কার। প্রতি বছর The Royal Sweden Academy of Science এর পক্ষ থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে সাহিত্য, বিশ্ব শান্তি, রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান এবং মেডিসিন বা ফিজিওলজি তে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই প্রাইজ পেয়ে থাকেন নোবেল বিজয়ীরা।
ডিনামাইটের আবিষ্কর্তা ও সুইডিশ রসায়নবিদ স্যার আলফ্রেড নোবেলের করে যাওয়া উইলের ভিত্তিতে সর্বপ্রথম ১৯০১ সালে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। শেষবার ২০২২ সালে মৃত্যু পূর্বে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এই পুরস্কারের জন্য উৎসর্গ করে যান। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ক্ষেত্রকে এই পুরস্কারের (Nobel Memorial Prize) জন্য সংযোজন করা হয়। কেবল নোবেল শান্তি পুরস্কারটি নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া হয় অন্যান্য পুরস্কার গুলি TRSAS এর পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়। উল্লেখ্য প্রথম (১৯১৪-‘১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-‘৪৫) চলাকালীন অর্থনৈতিক সংকটাবস্থার জন্য এই পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল।
নোবেল পুরস্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি স্বর্ণপদক, একটি শংসাপত্র ও ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় আশি লক্ষ টাকা) পেয়ে থাকেন পুরস্কার প্রাপকেরা। এই পুরস্কার সাধারণত জীবিত ব্যক্তদের দেওয়া হলেও বিশেষ কোনো কারণবশত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য মরণোত্তরও দেওয়া হয় এই পুরস্কার। আজকের প্রতিবেদনে আলোচনা করবো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য কি যোগ্যতা থাকতে হবে, কিভাবে আবেদন করবেন, কাদের সুপারিশ পত্র প্রয়োজন, নমিনেশন পদ্ধতি বিস্তারিত নীচে আলোচনা করা হলো।
কারা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য?
স্যার আলফ্রেড নোবেলের উল্লেখ করে যাওয়া সুপারিশ পত্র অনুযায়ী মানবসেবায় উৎসর্গীকৃত এবং মানবজাতির উন্নতিকল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ব্যক্তিরাই এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য।
কাদের এই পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
১৯০১ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত নোবেল বিজয়ীদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নিম্নলিখিত ব্যক্তিত্বগুলি নোবেল পুরস্কার লাভের মানদন্ড হিসেবে এগিয়ে রয়েছে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা:-
মহিলার তুলনায় একজন পুরুষের এই পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি:-
নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৯০১-২০২২ পর্যন্ত সর্বমোট ৬১৫ বার ৯৮৯ জনকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। যাঁর মধ্যে ৬১ জন মহিলা ও ২৭ টি অর্গানাইজেশন এই পুরস্কার পেয়েছে। যদিও মহিলা পুরস্কার বিজেতার সংখ্যা গত দুই দশক থেকে বেড়েছে কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে বলছে, মহিলার তুলনায় একজন পুরুষের এই পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মার্কিন নাগরিক হওয়ার চেষ্টা করুন:-
যদি জন্মসূত্রের রাশিবিজ্ঞান (Statistics) দেখলে বোঝা যায়, আমেরিকার অধিবাসীরা সর্বাধিক সংখ্যায় এই পুরস্কার জয়লাভ করেছে। এখনো পর্যন্ত ৪০৩ জন আমেরিকাবাসী এই পুরস্কার পেয়েছেন। এরপরেই যথাক্রমে স্থান রয়েছে যুক্তরাজ্য (১৩৭ জন), জার্মানি (১১৪ জন) ও ফ্রান্স (৭২ জন)।
নিজের জীবনকে মানবজাতির সেবায় উৎসর্গ করুন:-
ত্যাগের দ্বারা মানবকল্যাণে নিজের জীবনকে নিয়োজিত করে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হয়েছেন মাদার টেরেসা, দলাই লামার মতো মহান ব্যক্তিত্ব।
শান্তির বার্তা বহন করুন:-
আপনি যদি বিশ্ব শান্তির বার্তা বহন করেন অর্থাৎ বিশ্বের মানুষের মধ্যে শান্তি সমন্বয়ে ব্রতী হন। যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকা বাসীর মধ্যে বর্ণভেদ প্রথা দূরীকরণে সচেষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ এর ক্ষেত্রে মতানৈক্য সমাধানের জন্য সচেষ্ট ব্যক্তিরা এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন।
ধৈর্য ধরতে শিখুন:-
পৃথিবীর বেশিরভাগ নোবেল লরেট ষাটোর্ধ বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ৫২ বছর বয়সে, নেলসন ম্যান্ডেলা ৭৫ বছর বয়সে আবার জন বি গুডএনাফ ৯৭ বছর বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছেন। তাই ভালো ভালো কাজ করুন আর ধৈর্য ধরতে শিখুন। পুরস্কার পাবেন এই আশায় নয়, বরং পুরস্কার না পেলেও আগামী প্রজন্মের জন্য ভালো কাজ করে যেতে পারবেন, এই ভেবে কাজ করুন। মনে রাখবেন বিশ্বের অনেক যোগ্য ব্যক্তিই কিন্তু এই পুরস্কার পাননি। তারা সেটা আশাও করেন না।
সংস্থা তৈরি করুন:-
আপনি যদি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা তৈরি করে সেই সংস্থার মাধ্যমে ভালো ভালো কাজ করেন। তাহলে আপনিও নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারেন। যেমন World Food Programme মহামারীর প্রাক্কালে বিশ্বের অসংখ্য মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য ২০২১ সালে এই পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। এছাড়াও International Committee for Red Cross ১৯১৭ ও ১৯৪৪ সালে দুবার এই পুরস্কার পেয়েছেন।
কিভাবে আবেদন করবেন/ নমিনেশন কিভাবে পাবেন?
Nobel Prize এর জন্য মনোনয়ন পাওয়া খুব কঠিন একটা কাজ নয়। নোবেল পুরস্কার লাভের জন্য প্রথম ধাপে আপনাকে দ্য রয়াল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্স অথবা Norwegian Nobel Committee (যে ব্যক্তি যে বিষয়ের জন্য আবেদন করবেন সেই অনুযায়ী কমিটি নির্বাচন করবেন) এর কাছে একটি আবেদন ইমেইল পাঠাতে হবে ফেব্রুয়ারীর পূর্বে (৩১ জানুয়ারীর মধ্যে)। তবে এই কাজ আপনি নিজে করতে পারবেন না। কোনো উপযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা নোবেল কমিটির কাছে আপনার নাম সুপারিশ করাতে হবে।
সুপারিশ করানোর তালিকায় রয়েছেন পূর্বের কোনো নোবেলবিজয়ী (সবচেয়ে ভালো সুপারিশকারী)। এছাড়া পার্লামেন্টেের সদস্য, বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা মানবকল্যাণে নিয়োজিত (যেমন- United Nations, WHO, UNESCO, UNICEF ইত্যাদি)।
দ্বিতীয় ধাপে যেসকল ব্যক্তি মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের ডাকা হবে নোবেল কমিটির সদস্যদের সন্তুষ্ট করার জন্য। আপনি এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট বছরের নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং উক্ত বছর ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম অথবা নরওয়ের রাজধানী অসলো তে গিয়ে এই পুরস্কার গ্রহণ করতে হবে।
একনজরে ভারতীয় নোবেল জয়ীরা:-
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৩), সাহিত্য, গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য।
• সি ভি রামন (১৯৩০), পদার্থবিজ্ঞান, রামন বিচ্ছুরণের জন্য।
• হর গোবিন্দ খুরানা (১৯৬৮), মেডিসিন, জেনেটিক্স এ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য।
• মাদার টেরিজা (১৯৭৯), কলকাতা আর্ত পীড়িত মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গের জন্য।
• শুভ্রমান্যম চন্দ্রশেখর (১৯৮৩), নক্ষত্রের সম্প্রসারণ গঠনাকৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্য।
• অমর্ত্য সেন (১৯৯৮), অর্থনীতি।
• ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন (২০০৯), আরএনএ রাইবোজোম স্ট্রাকচার আবিস্কারের জন্য।
• কৈলাশ সত্যর্থী (২০১৪), বাচপান বাঁচাও আন্দোলনের মাধ্যমে শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
• অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (২০১৯), অর্থনীতিতে।